পরের জনমে যদি সুযোগ পাই, তবে আমি চাইবো পথ হতে। না, খানাখন্দে ভরা জীর্ণ-শীর্ণ পথ নয়। হয়তো রাজপথ, কিংবা হাইওয়ে, কিংবা নিতান্তই তুচ্ছ কানাগলি।
পথ কখনো কারোর গন্তব্য নয়। ছিলোও না কখনো। পথই মানুষকে পৌঁছে দেয় তার গন্তব্যে, তার গৃহে। তবে 'গৃহ' শব্দটায় আমার ঘোর আপত্তি। গৃহ যে শুধুই মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়, ইহা বোধহয় আজ সর্বজনস্বীকৃত একটি স্টেটমেন্ট। আর পথ? পথের সমস্তটাই গৃহ, সমস্তটাই এই অসীম মহাকাশের নিচে এক অন্তহীন কাব্য।
পথ হয়ে আমি সবার হৃদয়ের গল্প শুনবো। শুনবো তাদের আত্মার করুণতম সুর, জানবো তাদের মননের জটিলতম চিন্তাটি। উপলব্ধি করবো পথিকের দুঃসহ যাতনাগুলো। উপভোগ করবো তার সুখ। কণ্ঠ মেলাবো তাদের বিষাদমাখা গানগুলোর সাথে,
“আমার সময় হলো অন্তবিহীন পথ তোর সময় হলো নীরব যন্ত্রণা…”
দিনের বেলা অনুভব করবো শহরের ব্যস্ততা। এই ব্যস্ত নগরীতে কেউই কারোর নয়। কি এক বেনামী প্রতিযোগিতায় সবাই ছুটে চলেছে। কিন্তু কিসের আশায়? কেন আমাদের এই শহর-নগর-জনপদ? এসব প্রশ্নের সুতো হঠাৎ কেটে যাবে কোনো এক দরাজ কণ্ঠের সুরে,
“আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখরখানি বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি…”
পথ হয়ে আমি উপভোগ করবো আকাশের অঝোর কান্না। আকাশের কান্নার ভালোবাসার স্পর্শে পূর্ণ হবো। অথবা কোনো পূর্ণিমা রাতে চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় ভীষণ মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকবো মারিয়া'র দেয়া পাঁচটি নীলপদ্ম হাতে পূর্ণিমা দেখা হিমুর দিকে। সে নীলপদ্ম গ্রহণের ক্ষমতা হিমুর নেই। কিংবা দেখবো স্ট্রীটল্যাম্পের আলোয় দ্রুত হেঁটে চলা কেরানীটির দিকে। হাতে তার বেলিফুলের মালা ও খেলনা। ঘরে হয়তো তরুণী স্ত্রী, একটি ছোট সন্তান। কিংবা হয়তো কেউই নেই তার। এসবের স্থান হয়তো কোনো কবরস্থানের দুটি চিহ্নহীন কবরের ওপর।
পথ হয়ে সবচে' তীব্রভাবে অনুভব করবো সময়। কালে কালে পুরনো পদচিহ্ন মিলিয়ে যাবে সব, জয় হবে নূতনের। শুনবো নতুন নতুন কথা, গাইবো নতুন সব গান। তবু হয়তো কোনো নির্জন নিশুতি রাতে নস্টালজিক হয়ে ভাবতে বসবো,
“আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি…”
এরপরে একদিন পথের মৃত্যু হবে। কোনো এক ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শে দানবের তাণ্ডবলীলা নেমে আসবে আমার উপর। হয়তো ততোদিনে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত আমি খুশিই হবো। মুছে যাবে আমার কাছে সঞ্চিত তোমাদের সব গল্প, গান, কবিতা, কথা… স্মৃতি।
এসো, আমরা বিষাদের আনন্দ খুঁজি।






0 comments:
Post a Comment